আজকের বিষয় শুধুই মানসিক সমস্যা নয়, এই সমস্যা কীভাবে আমাদের সুস্থ, সুন্দর যৌন চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে তা আজ আমাদের জানার বিষয়। যদি তোমার কোনো মানসিক সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তা যে শুধুই মনের উপর প্রভাব ফেলবে তা নয়, তোমার শরীরের উপরও তা প্রভাব ফেলবে। তোমার যৌন জীবন ও যৌন চাহিদা প্রচন্ডরকমভাবে টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাবে।
সমাজে নানারকম টালবাহানা থাকে সত্ত্বেও মানসিক সমস্যা আজ মানুষের কাছে খুব পরিচিত এক সমস্যা। বিভিন্ন ধরণের ফেসবুক পোস্ট, অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়ার সৌজন্যে আমরা মানসিক সমস্যা কী, কত ধরণের হতে পারে, এই সকল বিষয়ে কিছুটা জানি। কিন্তু মানসিক সমস্যার কারণে যৌন জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তা কী আমরা আদৌ জানি?
আমরা খবর রাখি না, কিন্তু বেশীরভাগ যৌন সমস্যার গোড়াটা আমাদের মনেই থাকে। যৌন রোগের ব্যাপারটা আলাদা, কিন্তু যদি তোমার মনে হয় যে তুমি কোনো রকম মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছ ও তা তোমার স্বাভাবিক যৌন জীবনে সমস্যা ডেকে আনছে, তাহলে এখনি কোনো সাইকোলজিস্টের (psychologists in Kolkata) সঙ্গে যোগাযোগ করো।
“বর্তমানে সমাজের একটা বড় অংশ যৌনতা মানেই অচ্ছুত এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে”
আমাদের সমাজে এখনো যৌনতা নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের রাখঢাক বর্তমান। যতই শিক্ষিত হই আজও আমরা যৌনতাকে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মানতে দশবার ঢোক গিলি। কিন্তু ভালো খবর এটাই যে, খুব ধীরে ধীরে হলেও সমাজের একটা বড় অংশ যৌনতা মানেই অচ্ছুত এই ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসছে। তারা খোলাখুলি যৌনতা নিয়ে চিন্তা ও আলোচনা করছে। আর এটা সত্যিই আশার কথা। কারণ এই সকল ঘটনার মধ্যে একটা গভীর যোগসূত্র বর্তমান।
আমরা সকলেই জানি যে যে যৌনতা আমাদের মেজাজ ও মনের উপর কী মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। কেতাবী ভাষায় বলতে গেলে একদিকে যেমন শরীর থেকে এন্ডরফিন এবং অক্সিটোসিনের নিঃসরণ ঘটে অন্যদিকে আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য, অন্তরঙ্গতা অনুভব করতে পারি এবং নিঃসন্দেহে এর মত আনন্দ আর দুটি নেই।😉
“শরীরের চাহিদাকে জোর করে অস্বীকার করা মহানুভবতার পরিচয় নয়, তা বোকামি ও অজ্ঞতার পরিচয়”
জুন, ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, ওসিডি (O.C.D.) বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগার কারণে আগের জেনারেশনের তুলনায় এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌন আকাঙ্খা অনেক কমে যাচ্ছে। কি আশ্চর্যের কথা তাই না! তারপরেও সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণির মানুষজনদের বলতে শোনা যায় যে, এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা নাকি উচ্ছন্নে চলে গেছে!
কীভাবে প্রতিনিয়ত ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ওসিডির মত সমস্যাগুলো আমাদের জীবনের যৌন চাহিদা ও যৌন জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে আমাদেরই অজান্তে, চলো দেখে নেওয়া যাক।
ছেলেদের যৌন সমস্যা

অ্যাংজাইটির কারণে পুরুষদের মধ্যে যে যৌন সমস্যাটা সবথেকে বেশী দেখা যায় তা হল লিঙ্গ শিথিলতা বা ই.ডি. (erectile dysfunction-ED). প্রচুর ছেলে যাদের বয়স মাত্র ২০ বা ৩০-এর ঘরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের মধ্যে এই সমস্যা বর্তমান। বিশেষ করে যৌন জীবনের একদম শুরুর দিকে যখন ছেলেদের মধ্যে “আমিত্ব” এই ব্যাপারটা খুব বেশি থাকে, তখন এই আমিত্ব ও স্ট্রেস খুব বেশি তাদের মাথায় চেপে গেলে এই ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের সমস্যা দেখা যায়।
কিন্তু এই সমস্যা কিন্তু কোনোভাবেই শুধু যৌন সমস্যা নয়। অনেকেই ভয় পেয়ে খুব বেশী রকমের শরীরিক সমস্যা ভেবে বসে যার ফলে তারা আরো বেশী করে এই সমস্যায় ভুগতে থাকে। আসলে অ্যাংজাইটির কারণে যৌনতার সময়ে তারা শারীরিক ভাবে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে না, কিন্তু সেই ব্যাপারটা তারা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না।
সাধারণত ছেলেরা এই যৌন দুর্বলতার সমস্যায় বেশ কিছুদিন ভুগতে থাকলে তাদের মধ্যে রাগ, হতাশা, নিজের পুরুষত্ব নিয়ে হীনমন্যতা মারাত্মক রকমের কাজ করে। এটা খুবই স্বাভাবিক। অনেক সময় এই ই.ডি.-র কারণে তাদের মধ্যে মারাত্মক রকমের ডিপ্রেশন দেখা যায়।
এছাড়া ছেলেদের মধ্যে অন্যান্য যে যৌন সমস্যা দেখা যায় তা হল —
- শীঘ্রপতন (Premature ejaculation)
- যৌন কামনা কমে যাওয়া (Low libido)
- অর্গাজম দেরীতে হয়।
- রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন /Retrograde ejaculation. *
* (যদি মিলনের সময় বীর্য লিঙ্গমুখে যাওয়ার বদলে মূত্রাশয়ে ফেরত যায়, তখন এই সমস্যাকে রেট্রোগ্রেড ইজাকুলেশন বলে। সধারণত প্রস্টেট সার্জারি হলে ও ডায়াবেটিসের কারণে নার্ভে সমস্যা দেখা দিলে এই সমস্যা হয়)
ছেলেদের বিভিন্ন যৌন সমস্যা ও ইডি নিয়ে আমরা পরবর্তী পোস্টে খুলে বলব।
মেয়েদের যৌন সমস্যা

মেয়েরাও কিন্তু অ্যাংজাইটির কারণে অনেকসময় যৌন আনন্দ পায় না। যৌনতার সময়ে মেয়েরা অনেকসময় কোনোরকম উত্তেজনা অনুভব করে না, ইন্টারকোর্সের সময় যন্ত্রণা অনুভব করে বা তাদের কোনোরকম অর্গাজম বা রাগমোচন হয় না। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, যে সমস্ত মেয়েদের অ্যাংজাইটির সমস্যা (anxiety disorder) আছে, তারা ইন্টারকোর্সের সময় খুব যন্ত্রণা অনুভব করে। এই সমস্যাকে বলা হয় জেনিটাল পেনিট্রেশন ডিজঅর্ডার (genital penetration pain disorder (PVD))
এছাড়া অন্যান্য যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয় তা হল —
- Low sexual desire — যৌন মিলনে তেমন আগ্রহ নেই।
- Sexual arousal disorder — যৌন মিলনে পূর্ণ ইচ্ছা থাকলেও মিলনের সময় উত্তেজনা অনুভব করতে পারে না বা অনেক চেষ্টাচরিত্র করে উত্তেজনা আনতে হয়।
- Orgasmic disorder — যৌন মিলনের সময় যথেষ্ট পরিমাণে উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও এবং যাবতীয় শারীরিক মিলন ও ঘর্ষনের পরেও মেয়েটি অর্গাজমের সুখ পায় না।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যৌন সমস্যা
এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা সমাজের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত যে অবহেলা ও অসম্মান পেয়ে চলেছেন, তার ফলে তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা প্রচন্ড পরিমাণে লক্ষ্যণীয়। আর এজন্য দায়ী আমাদের তথাকথিত “ভদ্র ও শিক্ষিত” সমাজ। এই মানসিক সমস্যা তাদের যৌন জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা আমরা যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য সংগ্রহ করে পরের পোস্টে প্রকাশ করব।
শেষে এসে একটা কথাই বলার আছে। আমরা সবাই মানুষ এবং আমাদের অস্তিত্ব শুধুই মনে নয়, শরীরেও বটে। তাই জোর করে শরীরের সমস্যাকে উপেক্ষা করে কোনো লাভ নেই বরং ক্ষতি আছে। এই শরীরের একটা গূরুত্বপূর্ণ অংশ হল যৌনতা। তাই যেদিন আমরা আমাদের যৌনতা ও যৌন সমস্যাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে শিখব, সেদিন আমরা বড় হব, সেদিন আমরা প্রকৃত পক্ষে মানুষ হব।