হ্যালুসিনেশন কী এবং কেন | Hallucination
এমন কতদিন হয়েছে যে আমরা বন্ধুদের সঙ্গে বসে ইয়ার্কি মেরেছি যে জানিস তো আমি বেশ কিছুদিন ধরে ভুত দেখছি বা ফিসফাস করে কোনো কথা শুনছি। তখন তা শুনে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব ভয় পেয়ে গেছে বা কেউ কেউ এটা নিয়ে খুব ইয়ার্কি করেছে। কিন্তু ঘটনাটা হাসি ঠাট্টার বিষয় নয়। কিন্তু ঘটনাটা এত সহজ নয়। একেই হ্যালুসিনেশন বলা হয়ে থাকে।
হ্যালুসিনেশন কাকে বলে
হ্যালুসিনেশন হল মানুষের একরকমের মানসিক অবস্থা। এই ক্ষেত্রে মানুষ অলীক বস্তু চোখে দেখতে পায়, অলীক কথা শুনতে পায়। অকারণে দুর্গন্ধ নাকে আসে। হ্যালুসিনেশন সাইকোটিক ডিজঅর্ডারের একটা বৈশিষ্ট্য হতে পারে।
এই ধরণের উপসর্গ গুলি বিভিন্ন কারণে হতে পারে যেমন মানসিক সমস্যা, কড়া ডোজের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন এপিলেপ্সি অথবা অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেও হতে পারে।
হ্যালুসিনেশন কেন হয়
মানসিক সমস্যা – কোনো কিছু হ্যালুসিনেট করার বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষ করার অনেক কারণের মধ্যে মূল কারণ হল বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা যেমন স্কিজোফ্রেনিয়া, বিকার ও পাগলামি।
মদ্যপান – অনেক সময় অতিরিক্ত মদ্যপান করলে বা কোকেন সেবন করলেও মানুষ ভুলভাল জিনিস দেখতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের ড্রাগ যেমন এলএসডি বা পিসিপি ইত্যাদি ওষুধের কারণেও মানুষ অনেক সময় ভুলভাল জিনিস দেখতে বা শুনতে পেতে পারে।
ঘুমের সমস্যা – আবার যদি ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে যেমন দীর্ঘদিন অনিদ্রার কারণেও যে কেউ হ্যালুসিনেশনের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আবার যদি ঘুমিয়ে পরার কিছুক্ষণের মধ্যেই বা ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন ধরণের জিনিস দেখতে পাও তাহলে তাহলে তা হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তবে এটা স্বাভাবিক।
ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া – তুমি যদি শরীর বা মানসিক সমস্যার জন্য কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে থাকো তাহলেও তুমি হ্যালুসিনেট করতে পারো। বিভিন্ন ধরণের ওষুধ যেমন পার্কিনসন’স ডিজিজ (Parkinson’s disease), ডিপ্রেশন, সাইকোসিস, এবং এপিলেপ্সির ওষুধের এমন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই সমস্ত রোগের ওষুধ খেয়ে থাকলেও হ্যালুসিনেশন দেখা যেতে পারে।
হ্যালিসিনেশনের আরো অন্যান্য কারণ হতে পারে:
-
- খুব জ্বর হলে বিশেষত বাচ্চা ও বয়স্কদের ধূম জ্বর দেখা দিলে,
- মাইগ্রেনের সমস্যা হলে,
- খুব নিঃসঙ্গ হয়ে গেলে, (এটি মূলত বয়স্কদের মধ্যেই লক্ষ্যণীয়,)
- কোনো কারণে বেসামাল খিঁচুনি (seizures) হলে,
- বধির বা অন্ধ হলে,
- এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত হলে,
- বিভিন্ন ধরণের কড়া রোগ যেমন এইচ আই ভি-র তৃতীয় স্তরে (stage 3 HIV,AIDS) রোগী থাকলে বা ব্রেইন ক্যান্সার হলে, লিভার বা কিডনি ফেলিওরের মত সমস্যা দেখা দিলে রোগী হ্যালুসিনেট করতে পরে। এছাড়া ব্রেইন ট্রমা, চার্লস বনেট সিনড্রোম, ডেলিরিয়াম, ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার, কারণেও রোগী হ্যালুসিনেট করতে পারে।
হ্যালুসিনেশন কত রকমের?
দেখার ভুল
যখন কেউ যেকোন জায়গায় বিভিন্ন ধরণের জিনিসপত্র যেমন বিভিন্ন ধরণের আলো, বিভিন্ন আকৃতির বস্তু, মানুষ ইত্যাদি দেখতে আরম্ভ করে। অন্যেরা যা দেখতে পাচ্ছে না, হ্যালুসিনেশনের রোগী সেইসমস্ত বস্তু সেখানে দেখতে পারছে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যদি তুমি ঘরে কোনো মানুষ কে দেখতে পাও যে আদতে ওখানে নেই তাহলে সেটি হ্যালুসিনেশনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
গন্ধ সংক্রান্ত ভুল
যদি তুমি অন্য যে কোনো সময় কোনো বাজে দুর্গন্ধ পাও বা তাহলে বুঝবে যে তুমি গন্ধ সংক্রান্ত হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়েছ।
স্বাদের ভুল (Gustatory hallucinations)
এই ধরণের হ্যালুসিনেশন স্বাদ সংক্রান্ত। যদি তুমি হঠাৎ হঠাৎ কোনো বাজে স্বাদ যেমন লোহা লোহা টেস্ট (metal taste) পেয়ে থাকো মুখে তাহলে সেটা গাস্টেটরি বা স্বাদ সংক্রান্ত হ্যালুসিনেশনের অন্তর্গত। যারা এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত তারা বেশি করে এই ধরণের হ্যালুসিনেশনের মুখোমুখি হয়ে থাকে।
“শোনার ভুলের হ্যালুসিনেশনই সবথেকে বেশি হয়ে থাকে।”
শোনার ভুল
শোনার ভুলের হ্যালুসিনেশনে সবথেকে বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। কারোর যদি এই ধরণের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকো তাহলে মাঝে মাঝে বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ শুনতে পাবে, যেমন কেউ তোমাকে কিছু করতে বলছে বা কোনো কথা চুপি চুপি বলছে যা শুধু তুমি শুনতে পারছ। কেউ তোমাকে রেগে রেগে কোনো কথা বলছে তো, আবার কেউ ভালোবেসে তোমাকে কিছু বলছে সেই ধরণের কথাও শুনতে পারো। এইগুলি সবই শ্রবণ সংক্রান্ত হ্যালুসিনেশনের অন্তর্গত।
অনুভূতির ভুল
এই ধরণের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি তার চামড়ার ভিতরে সবসময় কিছু না কিছু টের পেয়ে থাকে। যেমন, যদি তুমি এই ধরণের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকো তাহলে দেখবে সবসময় তোমার মনে হবে যে চামড়ার ভিতরে কোনো পোকার মত কিছু হাঁটছে। অথবা তোমার মনে হবে তোমার শরীরের ভিতরে যা কিছু রয়েছে তা নিজে থেকেই নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। আবার হয়ত তোমার কখনো কখনো মনে হবে যে কেউ তোমার শরীর ছুঁয়েছে অথচ চারপাশে তাকিয়ে দেখলে কেউ নেই।
হ্যালুসিনেশন হলে কী করব
কোনো কারণে তোমার যদি মনে হয় যে তুমি কোনোভাবে হ্যালুসিনেট করছ তাহলে জলদি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করো। ডাক্তার প্রয়োজন মত বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা যেমন রক্ত পরীক্ষা বা মূত্র পরীক্ষা দিতে পারেন।
তুমি যদি তোমার আশেপাশের এমন কাউকে চেনো যে প্রায়ই হ্যালুসিনেট করছে তাহলে তাকে একা ফেলে না রেখে যত তাড়াতাড়ি হয় তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। কারণ অনেক সময় হ্যালুসিনেটের কারণে অকারণ ভয় ও সন্দেহের বশে তার খুব বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে, বা সে অন্যের ক্ষতি করতে পারে। খুব ভালো হয় যদি তুমি সেই অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে যতটা সম্ভব সময় কাটাতে পারো। অনেক সময় অনেক মানসিক সমস্যা শুধু কথা বলেই সারানো যায়।
হ্যালুসিনেশন কী ভাবে সারায়
এই ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ সবচেয়ে বেশি গ্রাহ্য। তবে হ্যালুসিনেশনের এখন অনেক চিকিৎসা বেড়িয়ে গেছে।যেমন,
সঠিক চিকিৎসা
কারো হ্যালুসিনেশন কোন পর্যায়ে রয়েছে তার উপরে চিকিৎসার বিভিন্ন ধরণ নির্ভর করে। যেমন, তুমি যদি অতিরিক্ত মদ্যপানের দরুণ বিভিন্ন বস্তু হ্যালুসিনেট করতে থাকো তাহলে ডাক্তার হয়ত সেক্ষেত্রে মদ খাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কোনো ওষুধ দেবে।
“হ্যালুসিনেশনের চিকিৎসা সম্ভব”
আবার ধর তোমার যদি পার্কিনসন’স ডিজিজের কারণে হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে আগের ওষুধ গুলো আর কাজ করবে না, তখন তোমাকে ডাক্তার অন্য ধরণের ওষুধ দেবে। হ্যালুসিনেশনের যথার্থ কারণ চিহ্নিত করা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
কাউন্সেলিং
হ্যালুসিনেশান আটকাতে কাউন্সেলিং খুবই গূরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ মানসিক অসুস্থতার কারণে হ্যালুসিনেট করতে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে কাউন্সেলিং খুবই সাহায্য করবে।
এক্ষেত্রে একজন সাইকোলজিস্টই আরো ভালো বুঝতে পারবে যে রোগী বিভিন্ন ঘটনা হ্যালুসিনেট কেন করছে? এছাড়া সাইকোলজিস্ট ভয় পাওয়ার সময় বা হ্যালুসিনেট করার সময় কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে সেই ব্যপারে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজি বা উপায় তোমাকে শিখিয়ে দেবে।
পুরোপুরি ভাবে সেরে ওঠা কী সম্ভব
হ্যালুসিনেশন থেকে পুরোপুরি ভাবে সেরে ওঠা সম্ভব কী না তা নির্ভর করছে রোগটার গভীরতার উপরে। যদি তুমি অনিদ্রার কারণে বা অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে বিভিন্ন ঘটনা হ্যালুসিনেট করতে থাকো তাহলে তা থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেরে ওঠা সম্ভব। আর তুমি যদি স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণে হ্যালুসিনেট করতে থাকো তাহলে ডাক্তারের কথা মত সঠিক ওষুধ খেলে প্রা্য় সেরে উঠতে পারবে। তবে সব ক্ষেত্রেই ডাক্তারের কথা মত চিকিৎসা গ্রহণ সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।
Psychotic hallucinations, whether they are visual or vocal, they address you. They accuse you. They seduce you. They humiliate you. They jeer at you. You interact with them.
Oliver Sacks
Best view i have ever seen !