নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার|আত্ম সর্বস্ব মূলক সমস্যা
(Narcissistic personality disorder)
আমরা সবাই নিজেদের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসি। আর সত্যি কথা বলতে গেলে এতে কোনো অন্যায়ও নেই। অল্প বিস্তর প্রশংসা আমাদের আরো ভালো কাজ করতে, আরো ভালো মানুষ হতে উৎসাহ জোগায়। কিন্তু সাবধান, সময়বিশেষে প্রশংসা বড় ভয়ানক জিনিস। এমন কাউকে চেনো যে সব সময় অন্যের কাছে নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে? সবসময় চায় যে অন্যেরা তার প্রশংসা করুক, তাকে ভালো বলুক। কিন্তু যদি এমনটা না হয়, যদি তারা কখনো প্রশংসার বদলে সমালোচনা শোনে ও শুনে প্রচন্ড ক্ষেপে যায়?
ব্যক্তিগত জীবনে কীভাবে আমরা এমন মানুষকে চিনতে পারব তা নিয়ে আজকের আলোচনা।
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (এন.পি.ডি) কী?
আমাদের সমাজে নার্সিস্টিক শব্দটি অনেকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেকে যারা নিজেদের নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত তাদেরকেও আমরা অনেক সময় নার্সিসিস্টিক বলে মনে করি। কিন্তু তা সবসময় সত্যি নয়। সাইকোলজি মতে, নিজেকে ভালোবাসা মানেই যে নার্সিস্টিক তা কিন্তু নয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে যাদের এই ধরণের সমস্যা আছে তারা নিজেদের সম্পর্কে একটা “আমি মহান বা আমি সেরা”– এই ধরণের ইমেজ তৈরি করে, নিজেদের সমসময় তাই মনে করে। নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে ভোগা মানুষ নিজের এই তৈরী করা ইমেজটাকে এত ভালোবাসে কারণ তারা নিজেদের যে ইনসিকিওরিটি বা ভয়গুলো আছে তা থেকে খুব সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে।
“এরা সবসময় চায় যে অন্যেরা তার প্রশংসা করুক, তাকে ভালো বলুক”
চলুন এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া যাক নার্সিসিজমের পিছনের করুণ কাহিনি। নদীর দেবতা সিফিসাস ও লিরিওপের পুত্র ছিলেন নার্সিসাস। পুত্রের জন্মের পর তার ভবিষ্যৎ জানার জন্য লিরিওপে অন্ধ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা টাইরেসিয়াসের কাছে গেলে সে অনেক গণনা করার পর জানায় যদি নার্সিসাস কখনো নিজের প্রতিবিম্ব না দেখে, তাহলে সে অনেকদিন বাঁচবে। সুপুরুষ হওয়ার কারণে নার্সিসাস ছিলেন খুবই অহঙ্কারী। আর কথায় তো আছে অহংকারই পতনের মূল কারণ। তো যাই হোক, নার্সিসাস অহঙ্কারের কারণে সবাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অকারণে অপমান করত। নার্সিসাসের এমন ব্যবহারে খুবই রেগে গিয়ে একদিন এক জলপরী প্রতিশোধের দেবীর কাছে তার শাস্তির জন্য আবেদন করলে দেবী তার প্রার্থনায় সাড়া দেন।
একদিন প্রচন্ড রোদ্দুরে ক্লান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে জলতেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে এক জলাশয়ের ধারে এসে বসে জল খেতে গেলে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়ে। নার্সিসাস নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ে যে খাওয়া দাওয়া ভুলে সে সেখানেই নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। তার প্রিয়জনেরা বারণ করলেও নার্সিসাস তাদের কথা শোনে না। নিজে যা ঠিক বলে মনে করেছে তা করে যেতে থাকে। এইভাবে অনেকদিন থাকার পর একদিন সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেখান থেকে জন্ম নেয় এক সুন্দর ফুল, যার নাম নার্সিসাস ফুল। ঘটনার সঙ্গে রোগের উপসর্গের মিল থাকায় চিকিৎসকেরা এই রোগের নামকরণ করেছেন “নার্সিসিজম বা নার্সিসাস কমপ্লেক্স।”
নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
-
- সবসময় প্রশংসা শুনতে চায় ও ভালোবাসে।
সবসময় মহান সাজার চেষ্টা। - অন্যদের কোনো বিষয় খারাপ লাগতে পারে এটা তাদের মাথায় পর্যন্ত আসে না, সহানুভূতি ও সমানুভূতির অভাব।
- উদ্ধত
- প্রচন্ড রকমের আত্মসর্বস্ব বা নিজেকে ছাড়া আর কিছে চেনে না বা বোঝে না।
- সবসময় অন্যদের কাছে তাদের দাবীর শেষ নেই।
- সবসময় প্রশংসা শুনতে চায় ও ভালোবাসে।
নার্সিসিজমের উপসর্গ
-
- সবসময় প্রশংসা শুনতে চায়
- আত্মবিশ্বাসের অভাব ও প্রশংসা শুনতে না পেলে মন খারাপ হয়ে যায় রোগীর
- সবসময় নিজের কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা
- যাদের সমাজে খুব নামডাক বা খুব টাকাপয়সা আছে তাদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রাখার প্রচন্ড চেষ্টা
- নিজেদের ক্ষমতা ও মেধা বা ট্যালেন্ট সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা
- অন্যদের কাজ বা ক্ষমতাকে ছোট করে দেখা
- সাফল্য, ক্ষমতা, সৌন্দর্য, ভালোবাসা, দায়িত্ব নিয়ে নিজের তৈরী করা বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে থাকা
- এই ধরণে রোগী নিজেদের সবসময় অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে এবং মনে করে তাকে বোঝার মত ক্ষমতা সবার নেই।
নার্সিসিজমের চিকিৎসা
এই ধরণের সমস্যার তেমন কোনো সমাধান নেই, কিন্তু যদি চিকিৎসা করানো যায়, তাহলে রোগীর ব্যবহারে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসা সম্ভব। তবে এই রোগের চিকিৎসা হল সাইকোথেরাপি। এই সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগী বুঝতে পারবে যে,
-
- তাদের এই ধরণের ব্যবহারের পিছনে আসল কারণ কী।
- তারা নিজেদের আবেগ যেমন রাগ ইত্যাদি আরো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
- রোগী নিজের ভুল কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে।
- সম্পর্ক আরো কীভাবে মজবুত করা যায় সেই ব্যাপারে আরো বেশী করে চেষ্টা করবে।
- অন্যেদের প্রতি নিজেদের পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশা কমানোর চেষ্টা করবে।
- নিজেদের এই ব্যবহার অন্যদের উপর কতটা প্রভাব ফেলছে, তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারবে।
সময়মতো চিকিৎসা করালে রোগী অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে ও অন্যেদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে। শুধু চিকিৎসা নয়, এই রোগ থেকে কিছুটা হলেও বাঁচতে চাইলে রোগীকেও চেষ্টা করতে হবে। অন্যের মতামতকে গূরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে; অন্তত মনে মনে স্বীকার করে নিতে হবে যে আমার একটা সমস্যা আছে আর সেখান থেকে আমাকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাহলেই যেকোন রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অন্তত চেষ্টাটা শুরু করলে সেখান থেকেই আমাদের আর নার্সিসাসের পথ আলাদা হয়ে যাবে।
Alert
যদি ভেবে থাকো যে শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়েই তুমি তোমার কাছের মানুষের এই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবে, তাহলে খুবই ভুল ভাবছ। শরীরের রোগ যেমন শুধু ভালোবাসা দিয়ে সারানো যায় না, তেমনি এই সমস্যার সমাধান শুধু ভালোবাসা নয়।